মে মাসটা আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মাস। এই মাসে আমার জন্ম হয়েছিল আবার এই মাসটিতেই আমি আমার প্রাণের মানুষ আমার আব্বা (মোঃ দুদু মিয়া) কে চিরতরে হারিয়ে ফেলি। সে হিসেবেই এই মাসটার গুরুত্ব আমার জীবনে খুব বেশী।
আজ ১৬ই মে,আব্বাকে হারানোর ঠিক আট বছর পূর্ণ হলো। দেখতে দেখতে কতটা বসন্ত চলে গেলো প্রাণের এই মানুষ ছাড়া। কত ঈদের নামাজ শেষ করে,চুপ করে হলো ঘরে ফেরা।
আব্বার হাত ধরে তিন ভাইয়ের নামাজে যাওয়া শেষ কবে হয়েছিল ভুলে গেছি। শেষ কবে মুকিদ ভাইয়ের দোকান থেকে আমরা তিন ভাই ইচ্ছেমত চিপ্স আর জুস কিনেছি আব্বাকে সাথে নিয়ে ভুলেই গেছি।আব্বাকে ঘিরে আমাদের কি পরিমাণ হৈ হুল্লোড় ছিলো তা বলার অবকাশ রাখেনা। সময়ের পরিক্রমায় আমরা ধীরে ধীরে নিজেদের পথে হাটতে শিখেছি,পথ চলছি ধীরে ধীরে। আব্বা যদি দেখে যেতে পারতেন নিশ্চয়ই খুব বেশী খুশি হতেন। কি পরিমাণ দোয়া যে আমাদের জন্য করতেন,ভাবতেই আপ্লুত হই। এই একজন মানুষকে নিয়ে যে কি পরিমাণ আমি লিখতে পারবো,বলে বুঝাতে পারবো না। কিন্তু কেন যেন লিখতে পারিনা। কলম হাতে থাকেনা। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। ভাবনার জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।
আজ অনেক দিন পরে লিখতে বসেছি,আমার প্রাণের মানুষ আব্বাকে নিয়ে। আহ! স্পষ্ট মনে পড়ছে আমার সেইদিনগুলোর কথা। যে দুই দিন আব্বার সেন্সলেস বডি নিয়ে মেডিকেল এর এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌঁড়েছিলাম। ভেতরে দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো আব্বা আবারো আমাদের মাঝে সুস্থ হয়ে ফিরবেন। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা ছিলো ভিন্ন। আব্বা চলে যান মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে। আব্বার নিথর দেহ নিয়ে কবরস্থানের দিকে যাওয়া,ছোট দুই ভাই তারেক আর রুবেল কে সাথে নিয়ে আব্বাকে নিজ হাতে মাঠিতে রাখা। অসংখ্য প্রিয়জন,শুভাকাঙ্খী, আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব, এলাকাবাসীকে নিয়ে আব্বার শেষ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা। আব্বার শিখানো দোয়াগুলো পড়ে পড়ে কবরস্থ করা এগুলো আমি ভুলি কীভাবে।
আব্বাকে হারানোর পর থেকে আমাদের পথচলায় বিরাট ভিন্নতা চলে আসে। বৈরি পরিবেশ দেখেছি। পৃথিবীর কঠিন রুপ খুব ভালোভাবে আমাদের দেখা হয়েছে। এরমাঝেও অনেক ভালো মানুষের সান্নিধ্য আমরা পেয়েছি,অনেকের আন্তরিক সহযোগিতা খুব পেয়েছি। আপনারা ভালো থাকুন সবসময় যাঁরা আমাদের কঠিন সময়ে আমাদের রেখে চলে যান নি। আপনাদের প্রতি আমাদের দোয়া,ভালোবাসা আজীবন থাকবে।
আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া কঠিন এই পথচলায় আমরা এক মুহুর্তের জন্য হলেও আব্বার রেখে যাওয়া উত্তম আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি। আল্লাহ যেন বাকি জীবনটাও আব্বার দেওয়া উত্তম শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরে পথ চলতে পারি,এই কামনাটুকু আজীবনের।
আব্বার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল সিলেট জজকোর্টের বিভিন্ন সেরেস্তায় গেলে,এখনো আব্বার পরিচয় দিলে মানুষ খুব স্নেহ করেন। বলেন কোর্টের মত জঠিল এক জায়গায় তোমার বাবার মত এত ভালো মানুষ খুব কমই ছিলেন। ভেতরে কি যে ভালো লাগা কাজ করে তখন,সেটা বুঝাতে পারবোনা। ছেলে হিসেবে এটা অনেক বড় প্রাপ্তির বিষয়। আমরা এমন একজন বাবার সন্তান যাঁর পরিচয় দিতে আমি প্রাউড ফিল করি।
একবার এক ভাই বললেন,কোর্টে কি এক মামলায় উনাকে কাস্টডিতে ডুকতে হয়েছিল। ভয়ার্ত এই মানুষটি যতক্ষণ কাস্টডিতে ছিলেন ততক্ষণ আব্বা উনার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বলছিলেন কোন অসুবিধা নেই ভাতিজা,চিন্তা করোনা,আমি তোমার পাশে আছি।তোমাকে সাথে করে নিয়ে পরে কোর্ট থেকে বের হব। এই যে মানুষের পাশে থেকে,মানুষের কঠিন সময়ে মানুষের কাজে লাগতে পারাটা,সকলের ভাগ্যে জুটেনা। যা আব্বা করে গেছেন,এসবের দোয়ার বরকত আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। একদম ভেতর থেকে এটি আমরা বিশ্বাস করি।
বুঝতে যখন শিখলাম,আব্বাকে নিয়ে ভাবনার পরিধিটা আরো বেড়ে গেলো। আমি কতদিন শুনেছি এলাকার অনেকেই মামলা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে আব্বার কাছে পরামর্শ নিতে আসলে,আব্বা সর্বোচ্ছ চেষ্টা করতেন যাতে মামলা-কোর্টের দারস্থ না হয়ে বিষয়গুলো স্থানীয়ভাবেই সমাধান করার কথা বলতেন। অনেকটা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে সমাধানের পথ তৈরি করতেন। এরজন্য যে অনেক এর চক্ষুশূল হন নাই,তাও না কিন্তু।
একদম কাছ থেকে আব্বার এসব গুণগুলো দেখেছি। অবচেতন মনেই এগুলোকে আমরা ধারণ করেছি।
আমাদের চাতল শাহী জামে মসজিদের দীর্ঘদিনের সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। মসজিদের হিসাব সংক্রান্তের ব্যাপারে এতো সচেতন এবং সেনসেটিভ একজন মানুষ ছিলেন যে,মুরব্বিয়ানদের মুখে শুনেছি আব্বা একবার হিসেব করে,পুনরায় হিসেব করে পরে খাতা মেইনটেইন করতেন আল্লাহর ঘর মসজিদের। যাতে করে হিসাবে কোন হেরফের না হয়,সেক্ষেত্রে খুব সচেতন ছিলেন।বিন্দু পরিমাণ দায়িত্বের জায়গায় হেলা করতেন না। এই শিক্ষাগুলো আমাদেরকে আব্বা হাত ধরে শিখিয়েছেন। দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে নিজের সর্বোচ্ছটুকু দিয়ে কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয় তা আব্বাকে দেখে শিখেছি।
যুগের স্রোতে গা ভাসিয়ে পথচলা আব্বা মোটেই পছন্দ করতেন না।ঢিলে-ঢালা পোষাক পরতেন।
একবার মনে পড়ে,আমি মদন মোহন কলেজে পড়ার সময় ব্যাকহাম স্টাইলে চুল সাজিয়ে কলেজে যাচ্ছিলাম। আব্বা তখন বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে বাড়ির সামনে কি এক ব্যাপারে আলাপে ছিলেন। আমি সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখেই বলেছিলেন,চুল যেন পানি দিয়ে ভিজিয়ে সমান করে পরে ঘর থেকে বের হই। অনেকেই তখন বলেছিলেন আজ না হয় চলে যাক,পরের দিন ঠিক করে যাবে। আব্বা উনার কথায় স্ট্যাইট ছিলেন। সেসময়ই চুলকে মাথার সাথে একেবারেই মিলিয়ে নিয়েই ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। এরপর থেকেই রুচির ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমি চিন্তা করার প্রয়াস পাই। আমি জানতাম আমার বাবা যা করবেন,সবগুলোই আমাদের চরম ভালোর জন্যই করবেন।
কত যে মিস করি এই একজন মানুষকে। বাবা হিসেবে ছেলেদের প্রতি যা করতে হয় এরচেয়েও এত বেশী আমাদের জন্য করে গেছেন, যেগুলোর শুন্যতা আমরা খুব অনুভব করি। বন্দর থেকে আশা-নিতার আখনী নিয়ে স্কুলে যেতেন। স্কুলে বসিয়েই খাওয়া-দাওয়া করিয়ে পরে ঘরে নিয়ে ফিরতেন।
প্রতিদিনের পত্রিকা পড়তেন। আমাদেরকেও পড়তে দিতেন। একসময় পত্রিকা পড়াটা আমার এত অভ্যসে পরিণত হয়েছিল যে,একদিনের পত্রিকা পড়তে না পারলে, কেমন খারাপ লাগা কাজ করতো। চিন্তা করতে পারেন,একজন আদর্শ বাবার শিক্ষা কি পরিমাণের ইফেক্টিভ একজন সন্তানের জীবনে।
আজ অনেকদিন হয় আমাদের এই মহান শিক্ষক আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু উনার রেখে যাওয়া স্মৃতি,উনার দোয়া আমাদের সাথে সবসময় আছে। এই দোয়ার উপরে আমরা পথ চলছি,আমাদের আগামীর পাণে।
আল্লাহ আপনাকে আখেরাতের জীবনে খুব ভালো রাখুন আব্বা। আল্লাহ আপনাকে দান করুন,চিরসুখের স্থান জান্নাতুল ফেরদাউস,আমিন ইয়া রব।
লেখক ও সাংবাদিক।
Leave a Reply